Sunday, 26 December 2021

সমাজ-পরিচালনা এখন কাদের হাতে বনাম থাকা উচিত কাদের হাতে? মুফতী এ কে আযাদ আল কাদেরী [ ইন্ডিয়া ]

 


       ইসলাম একটি পূর্নাংগ জীবন-বিধান।  একজন মুসলিমকে তাঁর ধর্মীয় জীবন, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সমস্ত কিছুই পরিচালনা করতে হয় ইসলামী বিধান অনুযায়ী।  আর এজন্যই  প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ঈমান-আকীদা, ইবাদাত-বন্দেগী ও হালাল-হারাম সম্পর্কে মৌলিক বিদ্যা অর্জন করা ফারযে আইন বা অত্যাবশ্যক।   যারা এই পরিমান বিদ্যা অর্জন করবে না, তাদের পক্ষে ইসলামী বিধান অনুযায়ী স্বীয় জীবন যাপন করা অসম্ভব।       

       সমাজে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বা মাদ্রাসা-মাসজিদ-ঈদগাহ সহ যে কোন প্রতিষ্ঠান চালনার জন্য ফারযে আইন বিদ্যা থাকা অপরিহার্য।  হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহিমুহুল্লাহ বলেন,  যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে সে  সঠিকভাবে কাজ সম্পাদনের পরিবর্তে বরবাদ করবে তার চেয়ে বেশি [ তারীখে তাবারী, খন্ড নং, পৃষ্ঠা নং ৫৭২ ]।  হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বলেন, তোমরা নেতৃত্ব লাভের আগেই জ্ঞান হাসিল করে নাও।  আবূ আবদুল্লাহ্ বুখারী বলেন, আর নেতা বানিয়ে দেওয়ার পরও [ জ্ঞান অর্জন চালিয়ে যাও ], কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ বয়োবৃদ্ধকালেও ইলম শিক্ষা করেছেন [ সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইলম, বাব ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে সমতুল্য হওয়ার আগ্রহ ]।  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে বলেন, “ ওই সম্প্রদায়ের কী হল যে, তারা প্রতিবেশীদেরকে দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ দান করে না; দ্বীন শিক্ষা দেয় না, দ্বীনের বিষয়াবলী বোঝায় না, তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করে না, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে না? ওই সম্প্রদায়েরই বা কী হল যে, তারা প্রতিবেশী থেকে দ্বীন শেখে না, দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ নেয় না, দ্বীনের বিষয়াদি বুঝে নেয় না? আল্লাহর কসম! হয়ত তারা তাদের প্রতিবেশীদেরকে দ্বীন শেখাবে, দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ দান করবে, দ্বীনের বিষয়াদি বোঝাবে, সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে আর যারা জানে না ওরা তাদের থেকে শিখবে, সঠিক বুঝ গ্রহণ করবে, দ্বীনের বিষয়াদি ভালোভাবে বুঝে নেবে নতুবা আমি তাদেরকে দুনিয়াতেই নগদ শাস্তি দিব”।  [তবারানী, মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ খন্ড নং, পৃষ্ঠা নং ১৬৪ ]।

 

    এর অর্থ এই নয় যে, যে ব্যক্তি আলেম নন তিনি নেতৃত্ব প্রদানে অযোগ্য।  শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ সকলেই আমাদের সমাজের সম্পদ এবং পরম আদরনীয়।  শিক্ষক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোন বা  ব্যবসায়ী-শ্রমজীবী, সমাজে নেতৃত্ব প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে কেবল এই ফারযে আইন বিদ্যাটুকু অর্জন করে নিলেই হবে আর এই বিদ্যা অর্জন করা তেমন কঠিন কোন বিষয় নয়।  আমরা উপন্যাস-গল্প-থ্রিলার-পত্রপত্রিকা  পাঠে প্রচুর সময় দিতে পারি।  অথচ আল্লাহ পাক যে জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য ফরয করেছেন তার জন্য কি আমরা সময় বের করতে পারব না? আল্লাহ পাক বলেন, “ জ্ঞানীরা ও অজ্ঞলোকেরা কি এক সমান ?” [ কানযুল ইমান, সূরা যুমার, সূরা নং ৩৯, আয়াত নং ৯]। কুরআনে কারিমের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদেরকে ইলম প্রদান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের  মর্যাদা সমুন্নত  করবেন[ কানযুল ইমান, সূরা মুজাদালাহ, সূরা নং ৫৮, আয়াত নং ১১ ]।

      তবে সমাজ-নেতৃত্বের  বাস্তব চিত্র হল,  বর্তমানে বহু মাদ্রাসা-মাসজিদ-ঈদগাহে এমন লোকজন নেতৃত্বে আছে যারা এই ফারযে আইন বিদ্যা তো অর্জন করেনই নি, এমনকি তাঁরা  না কালেমা তৈয়বা শুদ্ধ করে পাঠ করতে পারে, না ফরয গোসল কিভাবে করতে হয় তা জানেন! অনেকে হয়ত পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম শেখেন নি বলে  সর্বদা অপবিত্রই থাকেন, অপবিত্রই অবস্থাতেই মাসজিদে যান এবং অপবিত্রই অবস্থাতেই ইনতেকাল করেন।  কেউ হয়ত মুখে সুন্নাত রাখতে লজ্জাবোধ করেন এবং প্রতিদিন দাড়ি কাটার মত হারাম কাজ করেন।  একটি ঈদগাহ কমিটির মিটিং প্রত্যক্ষ করলাম।  মিটিঙের শুরুতে না বিসমিল্লাহ শরীফ পাঠ করা হল, না কুরআন পাক তেলাওয়াত করা হলো।  না আল্লাহর পাকের প্রশংসা করা হোল, না রসূল পাকের উপর দরুদ শরীফ প্রেরণ করা হলো।  না মিটিং শেষে  দোয়া করা হলো  এমনকি সারা মিটিং জুড়ে ঈদগাহ কমিটির কেউ একবার আল্লাহ পাকের নামও নিলেন  না!এরুপ ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয় এবং এরুপ কমিটির সংখাও কম নয়।   এধরণের  কমিটি ইসলামের দৃস্টিতে নাযায়েয।  এই কমিটিগুলিই আবার বৈধ ও প্রশংশনীয় রুপ গ্রহন করবে যদি সম্মানিত সদস্যগণ ফারযে আইন বিদ্যাটুকু অর্জন করে নেন এবং সে অনুযায়ী জীবনশৈলীকে সংশোধন করে নেন।  এতে তাঁদের জন্য যেমন ইহকাল ও পরকালে রয়েছে মহাপুরস্কার,  তেমনি সমাজসংস্কারে এবং আদর্শ সমাজ গঠনে তাঁরা হয়ে উঠবেন মূল চালিকাশক্তি।

 

     বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বাধিক  জরুরী প্রয়োজন হল, প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালন কমিটি গুলিতে সংশ্লিস্ট সমাজের যোগ্য  ইমাম সাহেবগণকে সংযুক্ত করা।  এতে  নাযায়েয কমিটিসমূহও বৈধ রুপ গ্রহন করবে।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন, যখন কোনো সম্প্রদায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ ত্যাগ করবে, তখন তারা অহির বরকত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে [ তিরমিজি ]।  নিঃসন্দেহে সৎকর্মে নির্দেশ প্রদানে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করার ক্ষেত্রে ইমাম সাহেবগণই  সর্বাধিক সক্রিয় ও প্রভাবশালী।  তাঁরা হয়ত সমাজে জালিমদের কাছে ধমক খাচ্ছেন কিংবা শাসিত হচ্ছেন কিন্তু অন্যায় এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমাজ মেরামতে তারাই সবচেয়ে কার্যকর অবদান রাখছেন।  তারাই  সমাজে অপরাধে জড়িত ও কুরআনবিমুখ মানুষগুলোকে কোরআন ও হাদিসের কথা শুনাচ্ছেন।  বিচ্ছিন্নভাবে কোন  আলেম কর্তৃক অনভিপ্রেত কোন ঘটনা হয়ত  সম্পাদিত হয়ে যেতে পারে কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই অবহেলিত জননেতাগণই  নবীগণের ওয়ারিশ যারা নবুয়াতী ইলমের সংরক্ষণ ও জাতিকে নৈতিক দিকনির্দেশনা দানে নীরব  ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।  ফলে পরিচালন কমিটিতে যোগ্য  ইমাম সাহেবগণকে সংযুক্তকরণে বিরোধিতা করার অর্থ হলো ইসলামী বিধানের  বিরোধিতা করা।  এতে বিরোধিতাকারীর যে কেবল গোনাহ হবে তা নয়, বিরোধিতার ক্ষেত্রে অনড় থাকলে কুফরী হয়ে যাওয়ারও আশংকা আছে।

 

   আসুন!  সমাজ-পরিচালনা, সমাজসংস্কার  ও আদর্শ সমাজ গঠনে আমরা বলিষ্ঠ ভাবে ইসলামী দিকনির্দেশনা অনুসরণ করি।! এতে আমাদের ধর্মীয় জীবন, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন  রাষ্ট্রীয় জীবন হয়ে উঠবে শান্তি-ঋদ্ধ ও সুশৃঙ্খল।  

                                                                                                                                      দোয়াপ্রার্থী,

                                                                               মুফতী মুহাম্মাদ এ কে আযাদ আল কাদেরী                                                                                                              বাবলা, মালদাহ ।

মুঠোফোন – ৮০০১৬০৫৫১৫

 

Tuesday, 3 November 2020

প্রশ্নঃ প্রত্যেক বিদআতই কি গোমরাহী? সাহিহ বিদআতি দের পোস্টমর্টেম By Mufti Ak Azad Al Qadri

 প্রশ্নঃ প্রত্যেক বিদআতই কি গোমরাহী? সাহিহ বিদআতি দের পোস্টমর্টেম


উত্তর : এক বিশেষ শ্রেণির নামধারী সাহিহ শাইখ সুযোগ পেলেই সুর ধরে একটি হাদীস শরিফের একটি টুকরো সুর ধরে পাঠ করে। কুল্লু বিদাতিন দ্বালালাহ, কুল্লু দ্বালালাহ ফিন নার ....।

নি:সন্দেহে হাদিসটি সহিহ তবে ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। তারা কেবল এই হাদিসটি দিয়ে সবকিছুই বিদআত সাব্যস্ত করতে চান। বিদআতের কোন ভাগ মানতে চান না। অথচ কোন বিষয়ে কেবল একটি হাদিস দিয়েই চূড়ান্ত নীতি গ্রহণ করা মারাত্মক বিভ্রান্তি। সেই বিষয়ে আরও কোন দলিল থাকলে সবগুলো সামনে রেখে সিদ্ধান্তগ্রহণ বাঞ্চনীয়।

যারা উক্ত হাদিস দিয়ে সবকিছু বিদআত বলতে চান, বিদআতকে ভাগ করতে চাননা, তাদের যখন হযরত ওমর এর নিম্নোক্ত বক্তব্য نعمت البدعة هذه তথা ‘এটি কতইনা উত্তম বিদআত!’ [মু'আত্তাই ইমাম মালেক রহ.] দেই, যা তিনি সাহাবাদের জামাতবদ্ধ হয়ে তারাবীহ নামাজের ক্ষেত্রে বলেছিলেন তখন তারাই আবার বিদআতকে শাব্দিক ও পারিভাষিক ভাগ করে ফেলেন।

মূলত “প্রত্যেক বিদআতই পথভ্রষ্টতা” এই হাদিসটিকে অসংখ্য মুহাদ্দিস عام مخصوص منه البعض তথা ব্যাপক বিষয় থেকে কিছু আলাদা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। সহজ কথায় এটি দ্বারা আমভাবে সব বিদআতকেই গোমরাহ বলা যাবে না, বরং অন্যান্য দলিল দ্বারা কিছু বিষয় খাছ তথা গোমরাহমুক্ত বিদআত বলা হবে। নচেৎ অসংখ্য সাহাবাও বিদআতী সাব্যস্ত হবেন।

নিচের হাদিসটি লক্ষ্য করুন-
مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ ».
যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম রীতির প্রচলন করল অত:পর সে অনুযায়ী পরে আমল করা হল, যারা সে অনুযায়ী আমল করবে তার জন্য (উত্তম রীতির প্রচলনকারী) তাদের আমলের সমান সওয়াব লেখা হবে এবং আমলকারীদেরও কোন সওয়াব কমানো হবে না।
আর যে ইসলামে কোন মন্দরীতি চালু করল সে অনুযায়ী পরে আমল করা হল, যারা আমল করবে তাদের মন্দ আমল পরিমাণ তার জন্যও লেখা হবে এবং আমলকারীদের মন্দআমল থেকেও কমানো হবে না। [সহিহ মুসলিম]

লক্ষ্যনীয় হল ‘সব বিদআতই গোমরাহী’ হাদিসটিও সহিহ মুসলিম থেকে নেয়া। আগের হাদিস অনুযায়ী সব বিদাআত তথা নতুন রীতি গোমরাহ সাব্যস্ত হয় অথচ পরের হাদিসে উত্তমরীতি চালুর উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উভয়ে বৈপরীত্য মনে হলেও ইমামগণ হাদিসদ্বয়ের সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন।

আসুন দেখি হাদিসবেত্তা ইমামগণ كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ বা “প্রত্যেক বিদআতই পথভ্রষ্টতা।” হাদিসটির ব্যাখ্যায় কি বলেছেন?* হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানী বলেন-
والمراد بقوله : ( كل بدعة ضلالة ) ما أحدث ولا دليل له من الشرع بطريق خاص ولا عام "
অর্থাৎ- সব বিদআতই ভ্রষ্টতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক নতুন আবিষ্কৃত বিষয় যার খাছ কিংবা আম কোন শরঈ দলিল নাই। [ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী-১৩/২৫৪]
এ দ্বারা বুঝা যায় যে বিষয়ের কোন খাছ বা সুনির্দিষ্ট কিংবা আম বা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ দলিল আছে তা ‘সকল বিদআতই গোমরাহী’ হাদিসের অন্তর্ভূক্ত নয়।

সহিহ মুসলিমের অন্যতম ব্যাখ্যাকার আল্লামা আবুল আব্বাস কুরতবী রহ. হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন-
(( شر الأمور محدثاتها )) : يعني : المحدثات التي ليس لها في الشريعة أصل يشهد لها بالصحة والجواز ، وهي المسمّاة بالبدع ؛ ولذلك حكم عليها بأن كل بدعة ضلالة-
“নিকৃষ্ট বিষয় হল নতুন আবিষ্কৃত বিষয়াবলী। অর্থাৎ এমন নব আবিষ্কৃত বিষয় শরীয়তে তা সহিহ বা জায়েয হওয়ার কোন আসল বা দলিল নাই, তাকেই বিদআত বলা হয়। এজন্যই এর হুকুম দেয়া হয়েছে প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী হাদিস দ্বারা।” [আল মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীছি কিতাবে মুসলিম-৭/১৩৬]
উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যায় শরীয়তে যার দলিল নাই সেটাই বিদআত তথা গোমরাহী। আর যেটার দলিল আছে তা বিদআত হবে না। উল্লেখ্য ঈদে মিলাদুন্নবীর অগণিত শরঈ দলিল আইম্মায়ে উম্মত দিয়েছেন। সুতরাং তা বিদআত হওয়ার অবকাশ নেই।

সহিহ মুসলিমের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী রহ. বলেন-
وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ هَذَا عَامٌّ مَخْصُوصٌ وَالْمُرَادُ غَالِبُ الْبِدَعِ قَالَ أَهْلُ اللُّغَةِ هِيَ كُلُّ شَيْءٍ عُمِلَ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ قَالَ الْعُلَمَاءُ الْبِدْعَةُ خَمْسَةُ أَقْسَامٍ وَاجِبَةٌ وَمَنْدُوبَةٌ وَمُحَرَّمَةٌ وَمَكْرُوهَةٌ وَمُبَاحَةٌ-
প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী এটি আম (বক্তব্য হলেও) এর থেকে কিছু বিষয় খাছ করা হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল বেশিরভাগ বিদআত গোমরাহী। ভাষাবীদগণ বলেন বিদআত হল প্রত্যেক এমন বিষয় যা পূর্ব নমুনা ছাড়া আমল করা হয়। ওলামাগণ বলেন বিদআত পাঁচ প্রকার, ওয়াজিব, মানদূব, হারাম, মাকরূহ এবং মুবাহ...।
[শরহে মুসলিম-৬/১৫৪]

তিনি অন্যত্র আরও ব্যাখ্যা করেন-
(مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا) إِلَى آخِرِهِ فِيهِ الْحَثُّ عَلَى الِابْتِدَاءِ بِالْخَيْرَاتِ وَسَنِّ السُّنَنَ الْحَسَنَاتِ وَالتَّحْذِيرُ مِنَ اخْتِرَاعِ الْأَبَاطِيلِ وَالْمُسْتَقْبَحَاتِ ......... وَفِي هَذَا الْحَدِيثِ تَخْصِيصُ قَوْلِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَأَنَّ الْمُرَادَ بِهِ الْمُحْدَثَاتُ الْبَاطِلَةُ وَالْبِدَعُ الْمَذْمُومَةُ-
যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম রীতির প্রচলন করল তার জন্য প্রতিদান রয়েছে....... হাদিসের শেষ পর্যন্ত। এ হাদিসে উত্তম কাজের সূচনা করতে, উত্তম রীতি প্রচলন করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং বাতিল-ঘৃণ্য বিষয়াবলী উদ্ভাবন করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। এই হাদিসটি রাসূল ﷺ এর অন্য হাদিস ‘প্রত্যেক নবআবিষ্কৃত বিষয় বিদআত এবং প্রত্যক বিদআতই গোমরাহী’ হাদিসটিকে খাছ করেছে। (প্রত্যক বিদআতই গোমরাহী) হাদিস দ্বারা উদ্দেশ্যে হল বাতিল উদ্ভাবিত বিষয় এবং নিন্দনীয় বিদআতসমূহ। [শরহে মুসলিম-৭/১০৪]

এই ব্যাখ্যা থেকেও বুঝা গেল ‘সব বিদআতই পথভ্রষ্টতা’ দ্বারা প্রত্যেক মন্দ বিদআত ভ্রষ্টতা উদ্দেশ্য। উত্তম বিদআত নয়।


* ইমাম মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন-
وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ- أَيْ: كُلُّ بِدْعَةٍ سَيِّئَةٍ ضَلَالَةٌ لِقَوْلِهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ: " مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا "
‘প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী অর্থাৎ প্রত্যেক মন্দ বিদআতই গোমরাহী। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম রীতির প্রচলন করল তার জন্য তদানুযায়ী আমলকারীদের সমান প্রতিদান রয়েছে।’ [মিরকাত শরহে মিশকাত-১/২২৩]


উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায়-
=> প্রত্যেক বিদআত তথা নব আবিষ্কৃত বিষয়ই গোমরাহী নয়
=> ‘প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী’ হাদিসটির অর্থ হল প্রত্যেক মন্দ বিদআত গোমরাহী, উত্তম বিদআত নয়
=> ইসলামে উত্তম রীতি চালু করা স্বয়ং নবীজি ﷺ কর্তৃক অনুমোদিত
=> বিদআত তথা নতুন রীতি যার সরাসরি বা ব্যাখ্যামূলক দলিল কুরআন-সুন্নায় আছে তা মন্দ নয়
=> বিদআতকে ভাল-মন্দ দুইভাগে বিভক্ত করা উম্মতের গ্রহণযোগ্য ইমামগণ দ্বারা সাব্যস্ত
[ Collected & Edited]

Thursday, 11 June 2020

মুক্তিদাতার জীবনকথা [ নবীসম্রাট এর সীরাত ] : পর্ব ১

মুক্তিদাতার জীবনকথা [ নবীসম্রাট এর সীরাত ] : পর্ব ১
লেখক: মুফতী মুহম্মাদ আবুল কালাম আযাদ আল কাদরী [ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুলাম]


       সীরাত অর্থ জীবনী। এই সিরাতের হাত ধরে ইতিহাস নামক বিষয়টির ক্রমবিকাশ ও সুষমামন্ডন। প্রাচীনকালে ইতিহাস রচনা আরম্ভ হয়েছিল বটে। কিন্তু তা ছিল অসংলগ্ন ও অসম্পূর্ণ। মুসলিমরা সর্বপ্রথম নবীসম্রাট মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাত বা জীবনী কে কেন্দ্র করে প্রকৃত ইতিহাস রচনার ধারাক্রম শুরু করেন। নবীসম্রাট এর সিরাত রচনার জন্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেইগণ দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে হুজুর সম্পর্কিত সকল খুঁটিনাটি তথ্য অনুসন্ধান, সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেন। এরই সূত্র ধরে মুসলিমরা “আসমাউর রিজাল” নামক এমন এক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন শাস্ত্র আবিষ্কার করেন যার মাধ্যমে 5 লক্ষ লোকের জীবনী জানা যায়। এরূপ দৃষ্টান্ত অন্য জাতির মধ্যে বিরল।


      যেহেতু সিরাত তথা ইতিহাসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন নবীসম্রাট মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাই বিশ্ব ইতিহাসে এ পর্যন্ত কতজন তার সীরাত রচনা করেছেন তার পরিসংখ্যান বের করা দুঃসাধ্য বিষয়। সিরিয়ার দামেস্ক থেকে প্রকাশিত “আল মুক্তাবিশ” নামক পত্রিকায় আজ থেকে প্রায় 93 বৎসর পূর্বে একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছিল যে কেবল ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় নবী সম্রাট সম্পর্কে প্রায় তেরশত গ্রন্থ লেখা হয়েছে। 93 বছর পর এই সংখ্যা বর্তমানে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা অনুমান করাও প্রায় অসম্ভব। বাকি থাকল মধ্যপ্রাচ্যসহ অবশিষ্ট বিশ্বের কথা। লাখ লাখ সীরাত গ্রন্থের নিখুঁত পরিসংখ্যান দেওয়ার কথা ভাবতে পারি না বটে! তবে এটুকু অনায়াসে বলতে পারি যে নবীসম্রাটকে নিয়ে যত নিয়ে যত সিরাত রচিত হয়েছে, মানব ইতিহাসে দ্বিতীয় টি কাউকে নিয়ে এমন মহাকান্ড ঘটে নি। তিনি উপস্থিত বিশ্বজুড়ে। সকল ভাষায়। সর্বত্র। বিভিন্ন আঙ্গিকে। বিভিন্ন ব্যঞ্জনায়। বিভিন্ন প্রেক্ষিতে। এতে পুষ্ট হয়েছে বিশ্ব ইতিহাস। আর বিশ্ব সাহিত্য হয়েছে নবীসম্রাটের অনুপম ব্যক্তিত্বের মাধুরীতে বাংময়।